“ফেয়ার এন্ড লাভলী” থেকে হঠাৎ কেনো “গ্লো এন্ড লাভলী”!

ফেয়ার এন্ড লাভলী - অব্যয় মিডিয়া
Image Source: REUTERS/Amit Dave

ভাবুনতো, বিয়ের বিজ্ঞাপনে যদি লিখা থাকতো, “এমবিএ পাত্রের জন্য যুবতী, চাকরিজীবী, সাদা, কালো বা শ্যামলা যেকোনো বর্ণের পাত্রী চাই! কিংবা এরকম কোন বিজ্ঞাপন থাকতো; সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ত্বক শ্যামলা করুন!

কারণ হঠাৎ করে স্কিন ক্রিম ব্র‍্যান্ডগুলোর মধ্যে নিজেদের নাম পরিবর্তনের হিড়িক পড়েছে।

ফেয়ার এন্ড লাভলী থেকে গ্লো এন্ড লাভলী

হিন্দুস্তান ইউনিলিভার তাদের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ফেয়ার এন্ড লাভলী থেকে ফেয়ার (Fair) শব্দটি উঠিয়ে নিয়েছে। যা ইতিমধ্যে বিজ্ঞাপনেও তারা ঢালাও ভাবে প্রচার চালাচ্ছে। তাদের নতুন নাম হয়েছে গ্লো এন্ড লাভলী

এমনকি L’Oréal (লরিয়াল)’ও তাদের কসমেটিকস প্রোডাক্ট গুলি থেকে হোয়াইট শব্দ সরিয়ে দিয়েছে। জনসন এন্ড জনসন তাদের প্রোডাক্ট ক্লিন এন্ড ক্লিয়ার বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে।

অন্যদিকে বিভিন্ন রঙের ত্বকের সাথে মিল রেখে BAND AID (ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ প্রতিষ্ঠান) মানুষের ত্বকের রংএর সাথে মিল রেখে বিভিন্ন রঙের ব্যান্ডেজ বিক্রি করছে।

এখানেই শেষ নয়, ভারতের বিভিন্ন বিয়ের প্রোগ্রাম আয়োজক ওয়েবসাইট এবং পাত্র পাত্রী চাই সম্বলিত সাইটগুলোও নিজেদের ওয়েবসাইট থেকে স্ক্রিন টোন ফিল্টার (গায়ের রং) অপশন উঠিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

নেপথ্যে কি ব্ল্যাক লিভস ম্যাটার?

তবে কি আমেরিকার ব্লাক লিভস মাটার দক্ষিণ এশিয়া বা উপমহাদেশেও প্রভাব ফেলেছে? যার কারণে উপমহাদেশের কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নাম ও ট্যাগ পরিবর্তনে বাধ্য করছে?

"ফেয়ার এন্ড লাভলী" থেকে হঠাৎ কেনো "গ্লো এন্ড লাভলী"!

কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠছে যে নাম পরিবর্তন করে গ্লো এন্ড লাভলী করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? এটা মেনে নিতে আমাদের দেশের কতজনই বা প্রস্তুত এটা মেনে নিতে যে শ্যামলা রঙ-ও সুন্দর?

বিশেষ করে এমন একটা অঞ্চলে (দক্ষিণ এশিয়া) যেখানে ফর্সা ত্বক’কে আদর্শ বলে মনে করা হয় এবং বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়? এবং এটি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ডিএনএ তে ঢুকে আছে! যেমন, আদী ভারতীয় আয়ুর্বেদে শেখানো হয়েছে কিভাবে গর্ভবতী মহিলারা তাদের সন্তানের ত্বকের রঙ সুন্দর করবেন- কেশর দেওয়া দুধ, কমলালেবু, মৌরি, নারকেল ইত্যাদি খেয়ে।

"ফেয়ার এন্ড লাভলী" থেকে হঠাৎ কেনো "গ্লো এন্ড লাভলী"!

যেহেতু এটি উপমহাদেশের রন্ধ্রেই লেগে আছে, তাই বর্ণবৈষম্য আমাদের দেশে জাতপাতের বিভাজনকে কেউ আরো জোরদার করে এবং আমাদের নিজেদের মধ্যেও একাধিক শেডের সাদা ও কালো রঙের মানুষ থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের থেকে বেশি কালো কাউকে দেখলেই ঠাট্টা করে থাকি যদিও এই ঘটনাটা ইচ্ছাকৃত নয়, তবু যথেষ্ট অপমানজনক।
আমরা ফর্সা হওয়ার ব্যাপারে এতটাই উঠেপড়ে লেগেছি যে ইউটিউবে কিভাবে রাতারাতি ফর্সা হওয়া যায় বলে সার্চ করলে হাজারো ভিডিও পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুনঃ

ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের যাত্রা যেভাবে

১৯১৯ সালে প্রথম ফেয়ারনেস ক্রিমের বিক্রি শুরু করেন ইএস পাটানওয়ালা। তিনি আফগানিস্তানের তৎকালীন রাজার সাথে পরামর্শ করে এর নাম রেখেছিলেন আফগান স্নো।
এমনকি হাজার ১৯৫২ সালে আফগান স্নো মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতার স্পন্সরও করে। এদিকে বর্তমান বানিজ্য জগতের লিডার ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী বাজারজাত হয় ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে। এবং খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ভারতীয় বাজারে ফেয়ার এন্ড লাভলীর রমরমা ব্যবসা দেখে ইমামি, হিমালয়া ও ফেম এর মতো জায়ান্ট ক্রিমগুলোও বাজারে রীতিমতো হুমরি খেয়ে পরে।

সবগুলো কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভারতীয় ফর্সা প্রীতি মনোভাবে উস্কানি দেয়। এবং তাদের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে আপনাকে ভালো চাকরি পেতে প্রমোশন পেতে ভাল পাত্র পেতে সাহায্য করবে।
বিজ্ঞাপনে যে মানুষদের বঞ্চিত বা সাফল্য পেতে ব্যার্থ হিসেবে দেখানো হয় তারা তূলনামূলকভাবে শ্যামলা বা কালো বর্ণের।

গ্লো এন্ড লাভলী obboy media
সৌন্দর্য চাকরী পেতে এক্সট্রা এডভান্টেজ দেয় বলে প্রচার করে ফেয়ারনেস ক্রীমগুলো

বিজ্ঞাপনগুলোর প্রতারণা ও বর্ণবৈষম্যে উস্কানিমূলক দৃশ্য এখন আমাদের সকলের কাছেই পরিষ্কার হলেও এ উপমহাদেশের মহিলাদের ফর্সা হওয়ার ক্রিম মাখা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

ফেয়ার এন্ড লাভলীর দাবি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন মহিলাই তাদের উৎপাদিত ক্রিম ব্যবহার করেন।

ফর্সা হবার রোগ!

ফর্সা হবার প্রলোভনে পড়ে এখন কেবল ভারত বাংলাদেশই না, আফ্রিকার নারীদের মধ্যেও এ প্রবণতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নাইজেরিয়ায় এই সংখ্যা প্রায় ৭৭% ।

এমনকি ফর্সা জাপানি এবং কোরিয়ান মহিলারাও সূর্যের তাপ থেকে নিজেদের ত্বককে বাঁচাতে ( সহজ কথায়, উজ্জ্বল রাখতে) বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করেন।

পড়ুনঃ যে মাস্টারপ্ল্যানে সিঙ্গাপুর আজ ধরাছোঁয়ার বাইরে

"ফেয়ার এন্ড লাভলী" থেকে হঠাৎ কেনো "গ্লো এন্ড লাভলী"!

ভারতীয় এক জরিপে দেখা গেছে ৮৪% মানুষ ক্ষতিকারক প্রভাব জানা সত্ত্বেও বিভিন্ন ধরনের কসমেটিক ট্রিটমেন্ট; যেমন স্কিন ব্লিচিং, কেমিক্যাল পিলিং, লেজার এবং হোয়াইটেনিং ইত্যাদি ব্যবহার করে। ছেলেরাও এখন ফর্সা না হওয়ার জন্য হীনমন্যতায় ভোগে এবং বর্তমান সময়ে বিপুল মাত্রায় বিভিন্ন ধরনের ফেয়ারনেস ক্রিমের ব্যবহার শুরু করছে।

কালো হবার জন্য দায়ী কি?

যদিও আপনার চামড়া রং কি হবে তা নির্ভর করে আপনার জ্বিন কতটা পরিমাণ মেলানিন উৎপাদন করে তার ভিত্তিতে। একই ভিত্তিতে আপনার চামড়ার রং, চুল এবং চোখের রং হয়। যত বেশি মেলানিন উৎপন্ন হয় আপনার চামড়া রং ততই বেশি কালো হবে, আর চামড়ায় ততই কম ভাঁজ পড়বে এবং স্কিন ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। স্কিন লাইটেনিং ক্রিম গুলো মেলানিন উৎপাদনে বাঁধা দেয়।

"ফেয়ার এন্ড লাভলী" থেকে হঠাৎ কেনো "গ্লো এন্ড লাভলী"!

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত উক্তি আছে, “গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন তা একরকম সুবাস ছড়াবেই।”

ফেয়ার এন্ড লাভলী প্রস্তুতকারী সংস্থা প্রস্তুতকারী সংস্থা এটা খুব ভালোভাবেই জানেন। এজন্য তারা জানেন যে প্রোডাক্ট এর নাম পরিবর্তন করে “ABC এন্ড লাভলী” বা “গ্লো এন্ড লাভলী” করে দিলেও তারা এতদিন যা করে আসছিলেন সেটাই বজায় থাকবে।

এমনকি গত বিশ বছর ধরে তারা বারংবার “ফেয়ারনেস” শব্দটি থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করেছে।

২০০১ সালের নিজেদেরকে ডার্ক সার্কেল আন্ডার আই ক্রিম বলে এই পণ্য তারা বাজারে বিক্রি করত।

এক বছর পরে ২০০৫ সালে মহিলাদের এমপাওয়ার করার জন্য ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্যারিয়ার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে। ২০১৩ সালে ফেয়ারেন লাভলী তাদের প্যাকেজিং পরিবর্তন করে সাদা থেকে গোলাপি করে এবং মাল্টিভিটামিন সহ বেস্ট এভার ফর্মুলা যুক্ত করে।

এরপর সানস্ক্রিন প্রটেকশন বাড়ায় আর তারপর ২০১৯ সালে বিজ্ঞাপন থেকে কালো থেকে ফর্সা হওয়া দেখানো বন্ধ হয়।

"ফেয়ার এন্ড লাভলী" থেকে হঠাৎ কেনো "গ্লো এন্ড লাভলী"!
ত্বক ফর্সাকারী পণ্যের বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন স্বয়ং শ্যাম বর্ণের দিপীকা পাডূকোন!

তবে এখন কথা হচ্ছে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম ব্র‍্যান্ড কি এমন একটি মার্কেট ছেড়ে দিবে! যেখান থেকে গ্লো এন্ড লাভলী আয় করতে পারতো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার?

না, ফেয়ার এন্ড লাভলী ইউনিলিভারের বিউটি অ্যান্ড পার্সোনাল কেয়ার ডিভিশনের চেয়ারপার্সন সানি চিয়ান বিবৃতিতে বলেন, তারা ‘ফেয়ার’ শব্দটি বাদ দেবেন। যাতে বর্ণবাদের কোনো গন্ধ মিশে না থাকে। ‘ফেয়ার’, ‘হোয়াইট’ ও ‘লাইট’ শব্দগুলোকে সৌন্দর্যের একটি নির্দিষ্ট ধরনের অর্থ হিসেবে আমরা ধরে নিতে অভ্যস্ত; অথচ সেটা ঠিক নয়। আমরা সেটাই আপাতত বোঝাতে চাই। নতুন নাম গ্লো এন্ড লাভলী।

“ফেয়ার” থেকে “গ্লো” হয়েগেলেই কি কালো বা শ্যামলা বর্ণের মানুষ এই উপমহাদেশে লাঞ্চনা থেকে রেহাই পাবে বলে মনে করেন?

 

[ ছোটবেলায় পড়েছি বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিঃমিঃ। কিন্তু এখন পাঠ্যবইয়ের আয়তন নেই, বাংলাদেশের আয়তন বেড়েছে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ। বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন নিচের লিংকে,

বাংলাদেশের আয়তন কত? যেভাবে হলো ২,৪৭,৬৭৭ বর্গ কিঃমিঃ ]

আপনি রাস্তার বামদিক কেনো ব্যবহার করেন?