পুরান ঢাকা নামটা শুনলেই কেমন যেন রোমাঞ্চ অনুভব হয়। গোলকধাধার মতো অলিগলি, তার দুইধার জুড়ে পুরাতন সব দৃষ্টিনন্দন দালান, ঘোড়ারগাড়ি, বাকরখনি, বিরিয়ানি। আহা! কত সাজ, কত স্বাদের মেলা। এখানেই শেষ না, নবাবদের প্রাসাদ আহসান মঞ্জিল, আর্মানিটোলা গির্জা, বাহাদুরশাহ্ পার্ক, লালবাগকেল্লা, বলধা গার্ডেন, জিঞ্জিরা প্রাসাদ, বড়কাটরা, ছোটকাটরা, লালকুঠি, বিউটি বোর্ডিং, রোজ গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, উহ্ বলতে বলতে মুখ ব্যাথা হয়ে যাবে তবু দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর নাম বলে শেষ করা যাবে না।
পুরান ঢাকার পরতে পরতে ইতিহাস, সংস্কৃতির ছাপ আর আজকের আধুনিক ঢাকা গড়ে ওঠার গল্প। এতোসবকিছুর ভিড়েও পুরান ঢাকার প্রাণ হয়ে আছে যে প্রতিষ্ঠানটি, তার নাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিবছর দেশের প্রায় সকল অঞ্চল ও অন্যদেশ থেকে হাজারো শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠানটির সুবাদে স্পর্শে আসে পুরান ঢাকার সক্রিয়তার। ফলে পুরান ঢাকার সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগছে সারাদেশে। পুরান ঢাকার সকল কৃষ্টি, সংস্কৃতি, নিজস্বতার যেনো সবচেয়ে বড় মুখপাত্র হয়ে আছে জগন্নাথ। তাইতো পুরান ঢাকা বললে প্রথমেই মনে আসে জগন্নাথের নাম।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, একটি ইতিহাস
পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া পুরান ঢাকার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৬১ বছর ধরে অবদান রেখে চলেছে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়নে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মহান ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেই শুরুর সময় থেকে দেশকে উপহার দিয়ে যাচ্ছে হাজারও সোনার সন্তান।
১৬১ বছরের সুদীর্ঘ সময়ের বন্ধুর পথাচলায় এখনও বিন্দুমাত্র কমেনি তার উজ্জ্বলতা। গত ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পনেরো বছর পেরিয়েছে পুরান ঢাকার প্রাণ। ইতিহাসের ১৬১ বছর ও বর্তমান সাফল্য ধারাকে স্বল্প আকারে তুলে ধরতেই অব্যয়ের আজকের আয়োজন।
যাত্রা শুরুর গল্প
১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল, যা কালের ক্রমন্বয়ে আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। তৎকালীন ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা দীননাথ সেন, ব্রজসুন্দর মিত্র, পার্বতী চরণ রায়, অনাথ বন্ধু মৌলিক প্রমুখের হাত ধরে ব্রাহ্ম স্কুলের যাত্রা। তবে প্রতিষ্ঠার একদশকেই আর্থিক সংকটের মুখমুখি হলে স্কুলের ভার গ্রহণ করেন মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদাররা। ১৮৭২ সালে বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় ব্রাহ্ম স্কুলের নাম বদলে তার বাবার নামে নামকরণ করেন জগন্নাথ স্কুল। ক্রমশ স্কুলের উন্নতি হওয়ায় ১৮৮৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে পরিণত করা হয়।
Read More: ড্যানিয়েল পেরেজ : দুইপা হারিয়েও লস অ্যাঞ্জেলসকে হাসিয়ে চলছেন যিনি
বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা
২০০৫ সালে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মাত্র ৭ একর জায়গায় যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ৬ অনুষদে ৩৬ ডিপার্টমেন্ট ও ২টি ইন্সটিটিউটে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৬ হাজারের বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় জগন্নাথের আত্মত্যাগ ও জগন্নাথ হল
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় জগন্নাথের ইংরেজিতে স্নাতোকোত্তর চালু ও স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে রূপান্তর করা হয়। জগন্নাথের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। জগন্নাথের গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই-পুস্তক, জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করা হয়। এই অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নাম জগন্নাথ হল রাখা হয়।
ভাষা আন্দোলন
মহান ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথের ছাত্র-শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিলো উল্লেখযোগ্য। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে যে ১০ জন এগিয়ে গেছিলেন তাদের অন্যতম জগন্নাথের কৃতি সন্তান চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। ভাষাশহীদ রফিক জগন্নাথের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও জগন্নাথ
২৫ মার্চ কালোরাতে হানাদারবাহিনী গনহত্যা শুরু করলে, পুরান ঢাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে জগন্নাথের ছাত্ররা। পরবর্তীতে জগন্নাথের হলগুলোতে হামলা চালায় হানাদার বাহিনী। পুরান ঢাকার নিয়ন্ত্রণ জগন্নাথে ক্যাম্প করে হানাদাররা। জগন্নাথের বর্তমান বিজ্ঞান অনুষদের মাঠটি বধ্যভূমি। শহীদ হন কয়েক জগন্নাথের হাজার শিক্ষক- শিক্ষার্থী। জগন্নাথের ছাত্র ও শিক্ষকরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখেন।
Read More: আপনি কেনো রাস্তার বামদিক ব্যবহার করেন?
তাদের অন্যতম, নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, গনসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীরবিক্রম) ও গণিত বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সময় আবুল কালাম আজাদকে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। পরে তার সন্ধান মেলেনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে জবিতে রয়েছে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য।
বঙ্গবন্ধু ও জগন্নাথ
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু জগন্নাথের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলেন, “I am at the disposal of the students of Jagannath College.”
চাকরির বাজারে অপ্রতিরোধ্য
চাকরির বাজারে গত ৪-৫ বছর ধরে অপ্রতিরোধ্য এক নাম জগন্নাথ। প্রতিটি সেক্টরেই জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের পদচারণা চোখে পড়ার মতো। তবে বিসিএস, পুলিশের এসআই, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগপরীক্ষায় সংখ্যার বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকছে জবি। এছাড়াও বিসিএস পরীক্ষায় বিভিন্ন ক্যাডারে প্রথম অবস্থান করছেন শিক্ষার্থীরা।
Read More: উদ্যোক্তা হতে হলে কি করবেন? যে কথা বলেনা কেউ
ধর্মীয় সম্প্রীতি
বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় মসজিদে ক্যাম্পাসের মানুষরা ছাড়াও আশেপাশের ও পথচলতি মানুষ নামাজ আদায় করেন নিয়মিত। এছাড়াও দেশের প্রথম ক্যাম্পাস হিসেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব দূর্গাপূজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২০১৯ সাল থেকে।
ভর্তিপরীক্ষা
প্রশ্ন ফাঁসে যখন দেশজুড়ে হাহাকার অবস্থা। তখনই ২০১৮ সালের ভর্তি পরীক্ষায় নতুন পরীক্ষা মডেল এনে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করে চমক সৃষ্টি করে জবি। বর্তমানে জাতির দীর্ঘদিনের দাবি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনেও নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিষয়ে কথা উঠলেই প্রথমেই বলতে হয় জবির বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রার। বলা যায় জবির আয়োজনে দেশের অন্যতম বৃহত্তম মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয় পুরান ঢাকায়। গতবছর মার্চে জগন্নাথ সম্পন্ন করেছে তার তৃতীয় সঙ্গীত উৎসব। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে প্রসারিত করতে সম্প্রতী নির্মাণ করা হয়েছে ‘মুজিব মঞ্চ’। এছাড়াও নিয়মিত চিত্র ও শিল্পকলা প্রদর্শন করছে জবির চারুকলা বিভাগ। নিয়মিত কাজ করছে, জবির সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, আবৃত্তি সংসদ, উদিচী, চলচ্চিত্র সংসদ, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি।
সর্ববৃহৎ সমাবর্তন
গত বছর দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহত সমাবর্তন আয়োজন করে জগন্নাথ। ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি ১৮ হাজার ২৮৪ জন গ্রাজুয়েট একসাথে সমাবর্তন গ্রহণ করেন।
হল আন্দোলন
হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জগন্নাথের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ২০০৯,২০১১, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে সংঘটিত হয় ৪টি বড় আন্দোলন। ২০১১ সালের আন্দোলনের পর ছাত্রীহল নির্মাণের ঘোষণা আসে। এরপর ২০১৬সালের আন্দোলনের পর নতুন ক্যাম্পাসের ঘোষণা আসে।
Read More: পৃথিবীতে কয়টি দেশ আছে ? ১৯৩ নাকি ২৪৯?
হল
১৯৮৫ সালে স্থায়ীদের সাথে সংঘর্ষে হাতছাড়া জগন্নাথের ১২টি হল। গত ২০ অক্টোবর, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে জবির প্রথম ছাত্রীহল ১৬তলা বিশিষ্ট “বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল” উদ্বোধন করেন উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান।
নতুন ক্যাম্পাস
কেরানিগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসের কাজ চলছে। ২০০ একর জায়গায় প্রায় ২০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হবে নতুন ক্যাম্পাস।
মেসজীবন
১৯৮৫ সালে ১২টি হল বেদখলের পর, মেসবাড়িই জগন্নাথের সিংহভাগ শিক্ষার্থীর আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। গোটা ঢাকাজুড়েই শিক্ষার্থীরা মেসে থাকলেও এদের বড়অংশের আবাস ক্যাম্পাস সংলগ্ন পুরান ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল। ক্যাম্পাস জীবনের পুরো সময়টাই কেটে যায় পুরান ঢাকার ব্যস্ততায়। ক্যাম্পাসের পিছনের বিসমিল্লাহ-জাকারিয়া হোটেল, স্টারের বিরিয়ানি, মতিঝিল ঘরোয়ার গরুর মাংসের খিচুরী, এইতো আনন্দ।
বিকাল হলে ভিড় জমে মূল ক্যাম্পাসের শান্তচত্ত্বর, কাঁঠাল তলা আর বিবিএ ভবনের নিচতলায়, পাল্লা দিয়ে ভিড়জমে বাহাদুর শাহ্ পার্ক আর সদর ঘাটে। জমে ওঠে আড্ডা, ফটোশেসন, কেউবা তোলে গিটারে টুংটাং সুর। এখানে এতো দেখার জায়গা, খাওয়ার জায়গা, কাউকে না ঘোষণা দিয়ে এক্সপ্লোরার হতে হয় না, সবাই হয়ে ওঠে এক-একজন নাম না জানা এক্সপ্লোরার। পুরান ঢাকার আলো-বাতাস না ঢোকা মেসবাড়িগুলোতে গাদাগাদি করে থাকা, খালার লবণ-ঝাল ছাড়া তরকারির পরও শিক্ষার্থীদের আগলে রেখেছে পুরান ঢাকা। কি যে মায়া তৈরি করেছে এ নগরি, বোঝা দায়, না হলে এতো কষ্টের পরও কেনো তাদের মনে হয়, চলছেতো জীবন!