তাং রাজবংশের শাসনকালকে চীনের শিল্প ও সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।তাং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা লি ইউয়ান। ৬১৮ থেকে ৯০৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিলো তাং বংশের শাসনকাল। তাং বংশের সময়ে চীন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল যা চীনের শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে এবং বৌদ্ধধর্মের চর্চার মাধ্যমে এশিয়ার বিশাল অংশ জুড়ে এর সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে।
তাং রাজবংশের সূচনা
ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুতে চীন উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত ছিল। তবে সুই রাজবংশের বিজয়ের মধ্য দিয়ে চীন ঐক্যবদ্ধ হয়। সুই রাজবংশ ৫৮১ থেকে ৬১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চীন শাসন করে। সুই বংশের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল ইয়াং জিয়ান। তাং রাজবংশের সূচনার পূর্ব পর্যন্ত মাত্র দুইজন সুই সম্রাট সিংহাসনে আরোহণ করেন।
লি ইউয়ান ছিলেন প্রথম সুই সম্রাটের চাচাত ভাই। ৬১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি গণ বিদ্রোহের সময় সিংহাসনের অন্যান্য দাবিদারদের পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি ৬২৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি তিনি শাসন করেছিলেন। পরবর্তীতে তার ছেলে তাইজং, দুইভাই এবং বেশ কয়েকজন ভাইপোকে হত্যা করার পরে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তাইজং তুর্কিদের কাছ থেকে মঙ্গোলিয়ার একটি অংশ দখল করেন এবং “গ্রেট খান” উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি তাংরা খিতান (পূর্ব এশিয়া) পর্যন্ত তুর্কি সেনাদের উপর আক্রমণ অব্যহত রাখেন এবং সিল্ক রোড পর্যন্ত অভিযান চালান।
তাইজং কনফুসিয়ান পণ্ডিতদের বেসামরিক চাকুরীতে সুযোগ দেন এবং কনফুসিয়ান রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয় তৈরি করেন। ফলে কোন পারিবারিক সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও প্রতিভাবান পণ্ডিতদের সরকারি দায়িত্বে প্রবেশের সুযোগ হয়।
সম্রাজ্ঞী উ
তাইজংয়ের পুত্র গাওজং ৬৫০ সালে সম্রাট হন, তবে তাঁর বেশিরভাগ শাসন সম্রাজ্ঞী উ’র নিয়ন্ত্রণে ছিল । উ’ তাইজংয়ের অন্যতম উপপত্নী ছিলেন। ৬৬০ খ্রিস্টাব্দে গাওজং স্ট্রোকের কারণে অক্ষম হয়ে পড়েন৷ তখন উ’, গাওজং-এর বেশিরভাগ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। গাওজং ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যাওয়ার পর উ’ তার দুই ছেলের মাধ্যমে সাম্রজ্যের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন।
উ’ ৬৯০ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে সম্রাজ্ঞী হিসাবে ঘোষণা করেন এবং একটি নতুন রাজবংশ, চাউ ঘোষণা করেন। একই সাথে, তিনি গ্রেট ক্লাউড সূত্র প্রকাশ করেন, যার দাবি ছিল যে বুদ্ধ মৈত্রী একজন মহিলা শাসক হিসাবে পুনর্জন্ম লাভ করেছেন এবং এর মাধ্যমে নিজেকে বৌদ্ধধর্মে মতে বৈধতা প্রদান করেন। উ’ ৭০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। এরই মধ্যে দিয়ে চাউ রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে ।
সম্রাট জুয়ানজং
উ’র নাতি, সম্রাট জুয়ানজং ৭১২ থেকে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। তার সময়ে চীনা সাংস্কৃতিক অন্যন্য উচ্চতা অর্জন করে। তিনি বৌদ্ধ ও তাও ধর্মগুরু এবং বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। জুয়ানজংয়ের সংগীত এবং ঘোড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল। এজন্য তিনি একদল ড্যানসিং ঘোড়া পুষতেন এবং বিখ্যাত ঘোড়া চিত্রশিল্পী হান গানকে তার দরবারে আমন্ত্রণ জানান। তিনি নতুন করে চীনা সংগীতে আন্তর্জাতিক প্রভাবের সুযোগ নিয়ে ইমপিরিয়াল মিউজিক একাডেমিও তৈরি করেন।
জুয়ানজংয়ের পতনে চীনে একটি স্থায়ী প্রেমের গল্পে পরিণত হয়েছিল। জুয়ানজং উপপত্নী ইয়াং গুয়াইফির প্রেমে এতটাই মগ্ন হন যে তিনি তার রাজকীয় দায়িত্বগুলি উপেক্ষা করতে শুরু করেন এবং দায়িত্ব পালনে তার পরিবারের সদস্যদেরও উচ্চ সরকারি পদে পদোন্নতি দেন। সম্রাটের দুর্বলতা বুঝতে পেরে, উত্তর প্রদেশের প্রতিনিধি যুদ্ধবাজ লুশান বিদ্রোহ ঘটিয়ে ৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী দখল করে, এসময় জুয়ানজংকে পালাতে বাধ্য করে।
এসময় রাজকীয় সেনারা, ইয়াং গুয়াইফির পরিবারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করা হলে জুয়ানজংকে রক্ষা করতে অস্বীকার করে। সৈন্যরা জুয়ানজংকে মেনে চললেও তারা ইয়াং গুয়াইফির মৃত্যুরও দাবি অব্যহত রাখে। সৈন্যদের মতে ইয়াং গুয়াইফির জন্য সম্রাট রাজদায়িত্বে অবহেলা করছেন। জুয়ানজং অবশেষে সৈন্যদের দাবি মেনে নেন এবং ইয়াং গুয়াইফির শ্বাসরোধে মৃত্যুর আদেশ দেন। পরে লুশান নিহত হন এবং জুয়ানজং তার ছেলের কাছে সিংহাসন হস্তান্তর করেন। লুশানের বিদ্রোহ তাং রাজবংশকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত এর পশ্চিম অঞ্চল রাজবংশের হাতছাড়া হয়ে যায়।
চলবে…