ইন্টারনেট, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য আবশ্যক হয়ে ওঠা এক জাল। এই অদৃশ্য জাল আমাদের প্রতিদিনের অগনিত কাজকে সহজ করে দিচ্ছে। আধুনিক প্রজন্মের স্মার্টফোনগুলোর সহজলভ্যতা ও সহজপ্রাপ্যতা আমাদের ইন্টারনেট পরিসেবা গ্রহণকে সহজ করে দিলেও এত ইতিবাচক দিকের মধ্যেও বর্তমানে ইন্টারনেট আসক্তি ও স্মার্টফোন অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলস্রুতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে।
ইন্টারনেট আসক্তি মাত্রা এতটায় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বর্তমানে বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীদের কাছে অসুস্থতা স্বরুপ। বিগত কয়েক দশকে ডিপ্রেশনে ভুগে আত্মহত্যাকারীদের একটা বড়অংশই মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অত্যাধিক আসক্ত ছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রযুক্তি নির্ভরতা বর্তমানে এতটাই বিপজ্জনক যে, সাধারন মানুষের জন্য চিন্তা করাটা কঠিন। কারণ এটা কীভাবে ক্ষতি করবে সেসম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই । তবে আমরা চাইলেই আমাদের দৈনন্দিন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং এই আসক্তিকে হ্রাস করতে পারি। ইন্টারনেট এর আসক্তি কমানোর কিছু বৈজ্ঞানিক উপায় নিয়েই আজকের আলোচনা, যা কিছু পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করা হলো ;
১. আসক্তি টেস্ট
যেকোন আসক্তি নিরাময় করতে হলে সর্ব প্রথম আপনাকে দেখতে হবে, আসক্তি বলতে কি বুঝায়? অনেকের মধ্যে এই ভুল ধারণা আছে, আমরা ইন্টারনেট বা স্মার্টফোনে আসক্ত। বাস্তবিকভাবে ইন্টারনেট আসক্তি কোন আসক্তি নয়। একবার ভাবুন তো, যে ব্যক্তি ফেসবুক বা গুগোলে চাকরি করে, যার কাজ সারাদিন এই সাইটে থাকা ও বিভিন্ন ডেটাবেজ আপডেট করা ও হালনাগাদ করা, তাকে তো কমপক্ষে ৮ ঘন্টা ফেসবুক বা গুগোলে থাকতে হয় তাহলে কি সেই ভদ্রলোক ফেসবুক/গুগোলে তথা ইন্টারনেটে আসক্ত?
কোনো ইতিবাচক ফলাফল পাবেন না জেনেও যেখানে আপনি প্রতিনিয়ত সময় ও এনার্জি আপনি দিয়ে থাকেন সেটাই আসক্তি।
অর্থাৎ আপনি যে সময়টা ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস আপডেট চেক করেন সেটা ইন্টারনেটের ইতিবাচক ব্যবহার , আর টাইম পাসের নামে সে মূল্যবান সময় অপচয় করেন সেটা বদঅভ্যাস বা আসক্তি।
এই আসক্তি রোধে আপনি সবচেয়ে কার্যকরী যে পদ্ধতি অনুকরণ করতে পারেন তা হলো কাগজে নোট (হিসাব) রাখা আপনি ঠিক কতক্ষণ ইন্টারনেটে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় “কাজের কাজ” করেন আর কতক্ষণ “সময় ক্ষেপণ” করেন। দিন শেষে যদি দেখতে পান আপনার “অকাজ” এর পাল্লা ভারী, তাহলে এটা খুবই সম্ভব যে আপনি আসক্ত।আর আসক্তি টেস্ট “পজিটিভ” আসলে দ্রুত পরের পয়েন্টে নেমে পড়াই শ্রেয়।
২. সমাধান খুঁজুন মনের গুগলে
প্রথম পয়েন্ট পর্যালোচনা করে হয়ত বুঝতেই পেরেছেন আপনি আসক্ত, এখন এ থেকে মুক্তির উপায় বের করা যাক। আপনি মোবাইল থেকে সকল সোশ্যাল মিডিয়ার এপ্লিকেশন ও বেশি সময় ব্যয় করা অন্য সফটওয়্যারগুলো ডিলিট করে দিতে পারেন, তবে গবেষণায় দেখা গেছে এটা তেমন কার্যকরী নয়। আপনি এক দিনেই এডিকশন বিনাশ করতে পারবেননা।
এক দার্শনিক বলেছিলেন “কে বলেছে সিগারেট ত্যাগ করা যায়না? আমি তো মোট ১৫৭ বার সিগারেট ছেড়েছি!”
ঠিক তেমনই, আপনি আসক্তি থেকে কার্যকরীভাবে মুক্তি পেতে চাইলে, ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য সময় নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। ধরে নিই, আপনি পূর্বে দৈনিক ৩ ঘন্টা ফেসবুকে থাকতেন, এখন নির্ধারণ করলেন ২ ঘন্টার বেশি কোনোভাবেই থাকবেন না। সেক্ষেত্রে বাকি সময় আপনি ফেসবুক ডিএক্টিভ বা ডিজেবল রাখতে পারেন। এক সপ্তাহ পর ২ ঘন্টাকে দেড় ঘন্টায় আনার পরিকল্পনা করলেন। এভাবে একসময় পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
৩. ভাগ্য খুলবে শিডিউলে
টু-ডু লিস্ট, পার্সোনাল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কখনো পড়াশোনা করলে আপনি অবশ্যই কোনো না কোনো সময় টু-ডু-লিস্টের কথা শুনেছেন। এটি মূলত আপনার দৈনিক কাজের শিডিউল প্ল্যানার। দিনের ঠিক কোন সময় কোন কাজ করবেন তার একটি তালিকা তৈরি করার এপ্লিকেশনই টু-ডু লিস্ট এপ। এ তালিকায় দিনের সকল কাজের সময় নির্দিষ্ট করে রাখলে এবং কাজ শেষে ঐ কাজ টাস্ক থেকে ক্লিয়ার করার ফলে আপনি জানতে পারবেন কোন কাজগুলো আপনি করেননি ও কোন কাজগুলো করেছেন। আরেকটু চেষ্টা করলে বুঝবেন আপনার আসক্তির জন্য কোন কাজটা আপনার মিস হয়েগেছে।এমনকি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আপনাকে রিমাইন্ডারও দিয়ে দিবে এই এপ্লিকেশনগুলো।
তেমনি একটি app হলো TickTick : ToDo List Planner, Reminder & Calendar
৪. অফলাইনে ফ্লাই
টেকনোলজির আসক্তি থেকে মুক্তি পাবার অন্যতম বড় উপায় হলো পার্থিব জগৎকে সময় দেয়া। তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম হলো নিজের পরিবার। প্রতি বছর আমরা “মা” কিংবা “বাবা” দিবসে দেখি আমাদের বন্ধুরা তাদের মা, বাবার ছবি দিয়ে বিভিন্ন আবেগী স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ভালোবাসার ভার্চুয়াল বহিঃপ্রকাশ করছে। দুঃখের বিষয় এই যে তাদের সিংহভাগই বাস্তব জীবনে বাবা মা’র কোনো কাজে সাহায্য করেননা। কিছু লাইক কমেন্টের আশায় এসব দিয়ে থাকেন।
অথচ আপনি চাইলে আসক্তি রোধে আজই রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করে মায়ের সাথে কিছু ভালো সময় পার করতে পারেন। রাতে বাবার সাথে একসাথে বসে টেলিভিশন দেখতে পারেন। তাতে আপনাদের দুজনেরই সময় খুব আনন্দের সাথে যাবে। চাইলে পুরোনো কোনো বন্ধুর সাথে কোথাও দেখা করতে পারেন কিংবা ফোন চালানোর সময় ত্যাগ করে ঐ সময়ে বাইরে হাঁটতে যেতে পারেন। মনে রাখবেন কোনো কিছু ভুলে থাকার সবচেয়ে বড় উপায় হলো নতুন কিছু দিয়ে ঐ স্থান দখল করে নেয়া।