২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক কলোম্বিয়া শান্তি চুক্তি। কলোম্বিয়ায় সরকার ও বামপন্থী ফার্ক বিদ্রোহীদের মধ্যে শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে সম্পাপ্তি ঘটে অর্ধশতাব্দী ধরে চলা গৃহযুদ্ধের।পাঁচ দশকব্যাপী এই যুদ্ধে প্রায় দু’লাখ ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৬০ হাজার মানুষ। বুলেট থেকে তৈরি বিশেষ কলম দিয়ে স্বাক্ষরিত হয় এই চুক্তি৷ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়াল সান্তোস এই চুক্তিকে ‘কলম্বিয়ার নতুন ভোর’ হিসেবে আখ্যা দেন। এই শান্তি চুক্তির জন্য ২০১৬ সালের শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন হুয়ান ম্যানুয়াল সান্তোস। ঐতিহাসিক এই ঘটনায় প্রেসিডেন্ট সান্তোসের সাথে প্রতিবার আরও একটি নাম উচ্চারণ করতে হয়, সেটা হলো তিমোচেঙ্কো।
রদ্রিগো লন্ডোনো এচাভেরি, যিনি তিমোলিওন জিমেনেজ ও ডাকনাম তিমোচেঙ্কো নামে সর্বাধিক পরিচিত। বামপন্থী ফার্ক বিদ্রোহীদের প্রধান নেতা এবং ফার্ক নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র। কলম্বিয়ার স্বঘোষিত বিপ্লবী সশস্ত্র সংগঠনটি যখন ঘোষণা করেছিলো, রদ্রিগো লন্ডনো তাদের নতুন নেতা হবেন, তখন সরকারের সাথে সম্ভাব্য শান্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার অবস্থান সম্পর্কে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তবে সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইতিহাসের অংশ হন তিমোচেঙ্কো। গেরিলা নেতা হওয়া সত্ত্বেও শান্তির কথা বলা তিমোলিওন জিমেনেজ বা তিমোচেঙ্কোর জীবন নিয়ে ‘ অব্যয় ‘ -এর আজকের আয়োজন—
প্রাথমিক জীবন
কিউবার বিপ্লবের পর ১৯৫৯ সালে, তিমোচেঙ্কোর জন্ম কুইন্ডিও অঞ্চলের একটি ছোট শহর ক্যালার্কায়। ঠিক একই স্থানে জন্মগ্রহণ করে ফার্ক-ইপি’র প্রতিষ্ঠাতা পেদ্রো আন্তোনিও মেরিন।তিমোচেঙ্কোর পরিবার ছিলো অর্থনৈতিকভাবে নিম্ন আয়ের এবং কমিউনিস্ট সমর্থক। হাইস্কুল শেষ করার পরপরই তিমোচেঙ্কো যোগ দেন কমিউনিস্ট লিগে। তিনি মস্কোর প্যাট্রিস লুমুমবা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন এবং কার্ডিওলজি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি কিউবাতে পড়াশোনা শেষ করেন। পরে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য যুগোস্লাভিয়া ভ্রমণ করেন। কিছু রিপোর্টে বলা হয়, তিনি প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ায় একজন ডাক্তার হিসেবে কাজ করেন। তবে বিপরীত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি সামরিক এবং গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন।
ফার্কে যোগদান
কলম্বিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠনে (জুভেন্টুদ কমুনিস্টা কলম্বিয়ানা – জুকো) থাকাকালীন আলফোনসো ল্যাপেজ মিশেলসেনের প্রশাসনের বিরোধিতা করেছিল। এরপর তিনি ফার্কের গেরিলা আন্দোলনে প্রবেশের করেন। ফার্কে তিমোচেঙ্কো গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত কিছু প্রভাবশালী অঞ্চলে স্থান পেয়েছেন । ধারণা করা হয়, তিনি মধ্য কলম্বিয়ার ম্যাগডালেনা মেডিও অঞ্চলে যাওয়ার আগে সহিংসতায় জর্জরিত এন্টিওকোয়া প্রদেশ থেকে ফার্কে তার যাত্রা শুরু করেন।
১৯৮৬ সালে, তিমোচেঙ্কোর নাম ছিল সংগঠনটির সাত সদস্যের কমান্ড ইউনিট, ফার্ক সচিবালয়ে। তিনি ছিলেন সচিবালয়ের কনিষ্ঠ সদস্য। মূলত তার কঠোর অবস্থান এবং তার যোদ্ধাদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার সক্ষমতার জন্য তিনি দ্রুত এত উপরে উঠে আসেন। এর একবছর পর তিনি পূর্ব ব্লকের দায়িত্ব পান।
১৯৯৩ সালে ফার্কের অষ্টম সম্মেলনের পর, গেরিলারা কলোম্বিয়ার সামরিক এবং আধা-সামরিক বাহিনীর দ্বারা প্রচণ্ড চাপের মুখোমুখি হয়। এসময় অনেক গেরিলা নিহত হন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় ফার্কের মধ্যে। স্থানীয় কমান্ডাররা তাদের নিজেদের গ্রুপেই শুদ্ধি অভিজান শুরু করেন। এসময় তিমোচেঙ্কো এগিয়ে আসেন এবং ফার্কের মধ্যে চলমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনেন। এই ঘটনায় ফার্কের মধ্যে তিমোচেঙ্কো তার কঠোর নীতির জন্য জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। জনপ্রিয়তায় ফার্কের তৎকালীন প্রধান ম্যানুয়েল মারুলান্ডা এবং তার উত্তরসূরী ও পরবর্তী প্রধান গিলারমো লেন সানজ ভারগাস, ওরফে আলফোনসো ক্যানোকেও ছাড়িয়ে যান। টিমোশেঙ্কো ১৯৯৩ সালে ম্যাগডালেনা ব্লকের প্রধান দায়িত্ব পান। ম্যাগডালেনাকে বলা হয় কমান্ডের অন্যতম কঠিন গেরিলা বিভাগ।
অপরাধমূলক কার্যক্রম
তিমোচেঙ্কোর জন্য ইন্টারপোল রেড এলার্ট জারি করে। তার গ্রেপ্তারের জন্য শতাধিক ওয়ারেন্ট জারি করা হয় বিভিন্ন সময়ে । ২০০১ সালে প্রাক্তন মেটা গভর্নর অ্যালান জারাকে অপহরণ, ১৯৯৯ সালে ভিচদা বিভাগের রাজধানী মিতির দখল ও ২০০৩ সালে ক্লাব এল নোগাল বোগোতে বোমা হামলার ঘটনার সাথে উঠো তিমোচেঙ্কোর নাম। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, মাদক পাচারের অভিযোগে তিমোচেঙ্কোর গ্রেপ্তারে সহযোগিতার জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পুরষ্কার ঘোষণা করে। যদিও ফার্ক নিশ্চিত করেছে যে মাদক পাচারে একটি গ্রুপ হিসাবে কোকা চাষীদের নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধ ছিল তারা।শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কলম্বিয়াতে তার গ্রেপ্তার পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেয়।
ভৌগলিক প্রভাব বিস্তার
তিমোচেঙ্কোর ফার্কের পূর্ব ব্লকের অধিনায়ক থাকাকালীন, কলোম্বিয়ার ইস্টার্ন প্লেইন, কুন্ডিনামারকা, বায়াক এবং কলম্বিয়ার অ্যামাজনে বেশকিছু এলাকায় নিজের প্রভাব তৈরি করেন । পরে তিনি মধ্য কলম্বিয়ার ম্যাগডালেনা মেডিও ব্লকের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ধারণা করা হয়, এরপর তিনি সেরানিয়া দেল পেরিজার পর্বতমালা এবং ভেনিজুয়েলার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত জুড়ে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করেন। এই অঞ্চলটি শেষ ১৫ বছরে বিদ্রোহীদের জন্য দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রথমত ফার্কের মাদক পাচারে সংশ্লিষ্টতা ছিলো এবং পার্শ্ববর্তী ভেনেজুয়েলায় সিমান্ত।
ফার্ক সুপ্রিম লিডার
২০১১ সালের নভেম্বর মাসে, কলম্বিয়ার সশস্ত্র বাহিনী মারুলান্ডার উত্তরসূরি আলফোনসো ক্যানোকে হত্যা করে। এরপরই ফার্ক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন তিমোচেঙ্কো। ৩০ বছরেরও বেশি সময় গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং কমান্ডার হিসেবে কঠোর হওয়ায় কট্টরপন্থীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন আগে থেকেই। ফার্ক প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিমোশেঙ্কো মিডল ম্যাগডালেনা ব্লকের অন্যতম কমান্ডার ছিলেন। সেসময় তার নেতৃত্বে প্রায় ৮০০ জন গেরিলা সদস্য ছিলো।
শান্তিপ্রক্রিয়া ও তিমোচেঙ্কো
২০১২ সালে, সংবাদমাধ্যমে বিদ্রোহীদের পক্ষে বন্ধুত্বপূর্ একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠিতে তিমোচেঙ্কো সরকারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য নতুন করে ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং শান্তি আলোচনায় যাওয়ার ইচ্ছা ইঙ্গিত করেন।
তার নেতৃত্বে, ফার্ক সেপ্টেম্বর, ২০১২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসের সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তি আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্তে আসে।
বৈদেশিক নীতি অনুসারে, কলম্বিয়ান সরকারের সাথে কথোপকথনের সূচনা হয় ২০১২ সালের নভেম্বর। তিমোচেঙ্কো ফার্ককে শান্তি প্রক্রিয়া ত্যাগ করা থেকে বিরত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। দু’বছরের অনুসন্ধান এবং চারটি আলোচনার পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরই মধ্য দিয়ে ফার্ক রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়।
রাজনৈতিক দল গঠন
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে, তিমোচেঙ্কো নবগঠিত ফার্কের রাজনৈতিক দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতির প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। তবে, গুরুতর হার্টের অ্যাটাকের কারণে তিনি প্রার্থীতা প্রতাহার করে নেন।
তিমোচেঙ্কো বর্তমানে নতুন ফার্ক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে পার্টির অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং শান্তি প্রক্রিয়ার পথে অনেক বাঁধা যেমন, ফার্কের প্রাক্তন নেতৃবৃন্দ, ইভান মার্কেজ এবং জেসিস সান্টরিচের পুনরায় অস্ত্র তুলে নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে তার কাজ সহজ হয়নি।
২০২০ সালে অর্থাৎ চলতি বছর জানুয়ারিতে তার বাড়ির কাছ থেকে দুইজনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। যাদেরকে তাকে হত্যার জন্য পাঠানো হয়েছিলো। ব্যর্থ হত্যাকাণ্ড চেষ্টা প্রমাণ করে যে, শান্তি চুক্তি গ্রহণের জন্য তিমোচেঙ্কোর প্রতি সবাই সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
শান্তি চুক্তির ঠিক মাসখানিক আগে, যখন নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়াল সান্তোসের নাম ঘোষণা হয়, অক্টোবরের ৭ তারিখে ‘ডয়চে ভেলে’ বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, ‘সন্তোসের সঙ্গে ফার্ক অধিনায়ক তিমোলিয়ান ‘‘তিমোচেঙ্কো” খিমেনেস কেন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন না, কমিটির সভাপতি কাসি কুলমান ফাইভ সে-বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি৷ নোবেল কমিটি অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করে না, বলে তিনি জানান৷ তবে তিনি বলেন যে, কলম্বিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়া থেমে যাওয়া ও গৃহযুদ্ধ আবার শুরু হওয়ার ‘বাস্তব বিপদ’ আছে৷ কাজেই প্রেসিডেন্ট সান্তোস ও ফার্ক গেরিলা নেতা রদ্রিগো লন্দনোর নেতৃত্বাধীন দুই পক্ষের যুদ্ধবিরতি মেনে চলাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷’
তবে যায় হোক, প্রায় ৩০ বছরের বিপ্লবী জীবন শেষে, দেশবাসীর শান্তির জন্য অস্ত্র ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা মোটেই সহজ বলা যায় না। তবে হয়তো তিমোচেঙ্কোর সিদ্ধান্ত কলোম্বিয়াকে নতুন ভোরের দিকে নিয়ে যাবে।