“চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদমতলায় কে? হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে, সোনামনির বিয়ে”। শৈশবের প্রিয় এই ছড়াটি ছাড়াও আরও একটি অতিপরিচিত কথা “বামন হয়ে চাঁদে হাত দিও না”। প্রচালিত বাংলা কথাটি মানুষ ভুল প্রমাণ করেছে অনেক আগেই। ১৯৬৯ সালের চাঁদের বুকে পা রেখে চাঁদের অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করেছেন নীল আর্মস্ট্রং। এরপর ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল ৪ বছরে চাঁদের মাটিতে ৬ বার অবতরণ করেছে মানুষ। তবে চাঁদে পা ফেলেই থেমে থাকেনি মানুষ, এখনতো রীতিমত কেনা-বেঁচা হচ্ছে চাঁদে জমি!
অবাক হচ্ছেন তাইতো? ভাবছেন, চাঁদের জমি কেনা কিভাবে সম্ভব? এটা সত্যি, আপনি কখনও কল্পনাও করে না থাকলেও এখন একটুকরো চাঁদের জমির মালিক হতে পারেন আপনিও। সেক্ষেত্রে চাঁদে আপনার প্রতিবেশী হতে পারেন শাহরুখ খান, টম ক্রুজ। কেননা এই তারকারাও চাঁদের বিভিন্ন অংশের জমির মালিক।
যেভাবে কিনবেন চাঁদে জমি
চাঁদে জমি বেঁচার সবচেয়ে পুরাতন প্রতিষ্ঠান আমেরিকান সংস্থা লুনার অ্যাম্বেসি। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে লুনার অ্যাম্বেসির মাধ্যমে নিজের নামে করতে পারেন চাঁদের একটুকরো জায়গা। বর্তমানে বিশ্বের ৩৫টি দেশে এদের অফিস আছে। তবে এদের অফিসে যোগাযোগ করা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনে যোগাযোগ করতে পারবেন লুনার অ্যাম্বেসির সাথে।
আরও পড়ুন,
- মানুষের মস্তিষ্ক খাওয়া অ্যামিবা আসলে কি? কিভাবে সুরক্ষিত থাকবেন?
- “ফেয়ার এন্ড লাভলী” থেকে হঠাৎ কেনো “গ্লো এন্ড লাভলী”!
বর্তমানে চাঁদের মোট ১৫ টি অঞ্চল বিক্রি করছে কোম্পানিটি। প্রতিটা অঞ্চলেরই রয়েছে আকর্ষণীয় নাম। নামগুলো হলো, বে অফ রেনবো, সি অফ ভেপর, লেক অফ ড্রিমস, লেক অফ হ্যাপিনেস, সি অফ ট্রানকিলিটি, দি লুনার অ্যালপস, অরিয়ান্টাল ফার সাইট, টরাস মাউন্টেন, সি অফ নেক্টার, সি অফ ইঞ্জিনউটি, সি অফ সেরিনিটি, জিও ক্লাউড,ওসেন অফ স্ট্রম, সি অফ রেইন, মস্কোভিএনস।
লুনার অ্যাম্বাসি ছাড়াও, লুনাররেজিস্ট্রি.কম, লুনারল্যান্ড.কম, মুনস্টেটস.কম থেকে কিনতে পারেন চাঁদের জমি। ভিসা, মাস্টারকার্ড, স্যুইচ বা মাস্টারো, পেপাল দিয়ে করতে পারবেন লেনদেন। পুরো প্রসেস শেষ হতে সময় লাগবে ২-৩ দিন। তবে ইন্টারন্যাশন্যাল ডেলিভারিতে আপনার হাতে কাগজপত্র আসতে সময় লাগতে পারে।
প্রতি একর ১৯ ডলার থেকে ৪৮ ডলারের মধ্যে কিনতে পারবেন এই অঞ্চলগুলোর যেকোনো একটিতে আপনার জমি। অর্থাৎ সর্বনিম্ন ১৬০০ টাকায় পেতে পারেন চাঁদে জমি। তবে দাম প্রায় কম-বেশি হয়, যা নির্ভর করে স্টক মার্কেট ও কোম্পানি ভিন্নতার উপর। তবে বেশি জায়গা কিনলে আছে ডিসকাউন্টের সুযোগও। সেক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ ছাড় পেতে পারেন।
আরও পড়ুন
- জুম অ্যাপ : যে গোপন সূত্র ধরে গুগল-মাইক্রোসফটকে ছাপিয়ে সাফল্যের শীর্ষে
- টেম্পল রান: যেভাবে পেলো অভূতপূর্ব সাফল্য ও জনপ্রিয়তা
- ফ্লাশ টয়লেট আবিষ্কারের পেছনের গল্প
আদৌ চাঁদের জমি কেনা সম্ভব?
১৯৬৭ সালের ২৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মহাকাশ আইনের উপর ভিত্তি করে ‘দ্য আউটার স্পেস ট্রিটি’ নামক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে অংশ নেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ততকালীন সোভিয়াত ইউনিয়ন। চুক্তি অনুসারে, পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে, চাঁদ এবং অন্যান্য যেসব বস্তু রয়েছে, কোনো রাষ্ট্র দখল বা নিজেদের একক সম্পত্তি হিসেবে দাবি করতে পারবে না। এখনও পর্যন্ত ১১০টি রাষ্ট্র এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এছাড়াও ২৩টি দেশ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এছাড়াও ১৯৭৯ সালে পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্য, চাঁদ ও অন্যান্য বস্তুতে কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি সমঝোতা প্রস্তাব উত্থাপন করে জাতিসংঘ। যাকে ‘মুন এগ্রিমেন্ট’ বলা হয়। মুন এগ্রিমেন্ট অনুসারে, মহাকাশে সকল কর্মকাণ্ড শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে হতে হবে। কোনো দেশ মহাকাশ স্টেশন বানাতে চাইলে জাতিসংঘকে জানাতে হবে।চাঁদ ও চাঁদের যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদে মানব সভ্যতার সবার সমান অধিকার থাকবে। তবে এই চুক্তিতে মাত্র ১১টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। এমনকি মাহাকাশ গবেষণার প্রধান দেশ তথা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন এবং রাশিয়া চুক্তিটিতে অংশ নেয়নি।
আরও পড়ুন
- নিউরালিংক: কাজ করতে হাত নয়, প্রয়োজন কেবল চিন্তার
- পৃথিবীতে কয়টি দেশ আছে ? ১৯৩ নাকি ২৪৯?
- ফুটবলের ডাকনাম সকার যেভাবে!
যেভাবে শুরু হলো চাঁদের জমি বিক্রি
আমেরিকার অধিবাসী ডেনিস হোপ, পেশায় জুতো ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্ত ব্যবসায় লোকসান দেখতে দেখতে শেষপর্যন্ত দেউলিয়া হওয়ার অবস্থায় পড়তে হয় তাকে। তখন ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়াতে কিছু একটা বিক্রি করতে চাইলেন তিনি তবে তার কাছে বেঁচার মতো কিছুই ছিলো না।
আমেরিকান আইন অনুযায়ী কোনো সম্পত্তির উপর কারও দখল বা দাবি না থাকলে যদি কেউ সে সম্পত্তির দখল দাবি করে এবং কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ না করে, সম্পত্তির মালিক হতে কোনো বাঁধা থাকবে না। এই আইনকে কাজে লাগাতে ডেনিস খুঁজতে থাকেন এমন সম্পত্তি যেখানে কারও দখল নেই।
খুঁজতে খুঁজতে ডেনিসের মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি আসে চাঁদ বিক্রির। তবে এখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ১৯৬৭ সালের ‘দ্য আউটার স্পেস ট্রিটি’ চুক্তি। তবে তাতে ডেনিসকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। চুক্তিতে দারুণ একটা ত্রুটি খুঁজে বের করে ফেলে সে। চুক্তিতে বলা হয়েছে কোনো রাষ্ট্র চাঁদের অধিকার নিতে পারবেনা তবে কোনো ব্যক্তির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা নেই।
সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইলেন ডেনিস, যেই ভাবা সেই কাজ। ডেনিস লেগে পড়লেন যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে। তথ্য সংগ্রহ শেষে স্থানীয় মেয়র অফিস থেকে করিয়ে নিলেন সরকারি কর্মকর্তার অনুমোদনও। এরপর পাঠালেন সেই অনুমোদনপত্র পাঠালেন রাশিয়া ও জাতিসংঘে। রাশিয়া ও জাতিসংঘে কেউ খুলেও দেখলো না ডেনিসের চিঠি। ফলস্বরূপ ১৯৮০ সালে চাঁদের মালিকানা পেয়ে গেলেন ডেনিস।
এরপর তিনি গড়ে তোলেন “লুনার অ্যাম্বাসি কমিশন”। তৈরি করেন ম্যাপ। ১৯৯৫ সালে মাত্র ২০ ডলারে বিক্রি করতে থাকেন ১ একর জায়গা৷ যা এখন ডেনিসকে করে তুলেছে কোটিপতি। প্রতিবছর তার আয় ২৭-৩০ হাজার ডলার। ২০০৪ সাল থেকে তিনি চাঁদের গভর্নরের গণভোটে বিজয়ী হয়ে আসছেন। তার দাবি চাঁদের দলিল তার কাছে আছে তবে এখনও কাউকে তিনি তা দেখাননি।
আরও পড়ুন
- ইন্টারনেট আসক্তি ছুঁড়ে ফেলুন চার বৈজ্ঞানিক উপায়ে!
- ইকোনো যুগঃ যেভাবে হারিয়ে গেলো এক প্রজন্মের নস্টালজিয়া
- হিংস্রতম প্রাণী হায়নার হাসি রহস্য
কারা কেনে এই জমি
বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর ভারতীয় উপমহাদেশে আলোচনায় আসে তার চাঁদের জমির বিষয়টি। ৫৫লাখ টাকার টেলিস্কোপ দিয়ে ঘরে বসেই যার দেখাশোনা করতেন বলে জানা যায়। এরপর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের অনেককেই আগ্রহী হয়ে চাঁদে জমি কিনতে দেখা যায়।
লুনার অ্যাম্বাসির মতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ তাদের কাছ থেকে জমি কিনেছে। চাঁদের মোট ৭.৫ শতাংশ জায়গা এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। তাদের এই তালিকায় আমেরিকান প্রসিডেন্ট জিমি কার্টার থেকে আছেন হলিউড তারকা টম ক্রুজ ছাড়াও আরও ২৫০জন হলিউড তারকা। এমনকি নাসার ৩০ জন চাকুরীজীবী জমি কিনেছেন চাঁদে। বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানকে জন্মদিনে চাঁদের জমি উপহার দেন তার এক ভক্ত।
আরও পড়ুন
- যে মাস্টারপ্ল্যানে সিঙ্গাপুর আজ ধরাছোঁয়ার
- ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির সবচেয়ে কার্যকরী উপায় কি?
- ফ্লাশ টয়লেট আবিষ্কারের পেছনের গল্প
চাঁদের জমি কেনা পুরোটায় কি ভণ্ডামি?
পুরোটা ভন্ডামি বলার সু্যোগ নেই কারণ ‘দ্য আউটার স্পেস ট্রিটি’ চুক্তির ত্রুটির বিষয়টু সত্য এবং পরে চুক্তি সংশ্লিষ্টরা এটা সংরক্ষণও করেনি। তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আপনি কিছু সময় দখল না করলে কোনো জায়গার মালিকানা পাবেন না। সে অনুযায়ী চাঁদের মালিকানার সুযোগ আপনার নেই।
তবে এতো কিছুর পরেও চাঁদের জমির দাম নামমাত্র। তাই বিশ্বজুড়ে সবাই অনেকটা মজার ছলেই এই জমি কিনে থাকে। ভালোবেসে উপহার দিয়ে থাকে নিজের প্রিয়জনকে। আর সৌখিন মানুষরা জীবনে কতকিছুইতো করে। থাকনা চাঁদে একটুকরো জমি। অন্তত বলতেতো পারবেন চাঁদে আমার জমি আছে।
[ কেউ আত্মহত্যা বা অন্য কোনো কারণে মৃত্যুর আগে যদি আপনাকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করে নোট লিখে যায়, তাহলে কি হবে জানতে ক্লিক করুন নিচের লিংকে,
কি হবে, কেউ মৃত্যুর পূর্বে আপনাকে দায়ী করে সুইসাইড নোট লিখে গেলে?