করোনাভাইরাসের জন্য থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ নির্ভরতা বাড়িয়েছে প্রযুক্তির উপর। প্রযুক্তির কল্যাণে বাড়িতেই শুরু হয়েছে অফিস, যাকে বলা হচ্ছে ‘হোম অফিস বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ । এমনকি বাড়ি থেকে ক্লাস করছে দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অনলাইনে মিটিং থেকে ক্লাস বাস্তবায়নে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে জুম অ্যাপ। বিশ্বগ্রামের প্রতিযোগিতায় মাইক্রোসফটের স্কাইপি, গুগলের হ্যাংআউট, গুগলমিট, গুগল ক্লাসরুমসহ অসংখ্য অ্যাপস থাকলে জুম অ্যাপের চাহিদার কাছে সবাই যেনো থোড়াই কেয়ার। জুম অ্যাপের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এর জনপ্রিয়তায় কোনো বাঁধা তৈরি হয়নি। তাহলে জুম (ZOOM) এমনকি গোপন সূত্র ব্যবহার করলো যা গুগল, মাইক্রোসফটকে পর্যন্ত পিছনে ফেলে দিলো! জুমের সাফল্যের গোপন সূত্র ও ইতিহাস নিয়ে ‘অব্যয়’ -এর আজকের আয়োজন।
জুম অ্যাপের ব্যাকস্টোরি
জুম (ZOOM) প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০১১ সালে। তবে জুম অ্যাপের ব্যাকস্টোরি জানার জন্য আমাদের আরো কয়েকবছর পিছনে যেতে হবে। এর প্রতিষ্ঠাতা এরিক ইয়ান বিল গেটস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজে কিছু করতে চেয়েছিলেন। এরিক এপালাইড ম্যাথামেটিকস ও মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রিপ্রাপ্ত। নব্বই দশকের মাঝামাঝি এরিক ইয়ান সিদ্ধান্ত নেন বেইজিং ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি ইউএস ভিসার জন্য আবেদন করেন। দূর্ভাগ্য তিনি প্রত্যাখ্যান হন। এটাই তার শেষ প্রত্যাখ্যান ছিলো না।
এক, দুই, তিন করে তিনি টানা সাতবার প্রত্যাখ্যান হন। তবে এরিক হতাশ হননি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যতক্ষণ না মার্কিন কাস্টমস তাকে না বলবে, ‘তোমাকে আমেরিকায় যেতে দেওয়া হবে না’, ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। তার এই সিদ্ধান্তেই ভাগ্য সহায় হয়। ১৯৯৭ সালে নবমবারের মত ভিসার জন্য আবেদন করার পর মার্কিন ভিসা লাভ করেন এরিক।
সেবছর এরিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন সদ্য শুরু হওয়া আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ওয়েবেক্সে। দ্রুতই ওয়েবেক্স তাদের লক্ষ্যে পৌঁছায় এবং ২০০০ সালে প্রথম ভিডিও কনফারেন্স সুবিধা বাজারে আনে৷ ২০০৭ সালে আইটি কোম্পানি সিসকো ওয়েবেক্সকে ৩.২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারে অধিগ্রহণ করে। ততদিনে এরিক ভিপি হিসেবে পদন্নোতি পেয়েছেন।
এসময় তিনি গ্রাহকদের মুখোমুখি হয়ে বুঝতে পারেন ওয়েবেক্স নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নয়। গ্রাহকরা যতটা সহজ আশা করেছিলেন ওয়েবেক্স ব্যবহার ততটা সহজ নয়। তিনি আবিষ্কার করেন ওয়েবেক্সের গ্রাহকদের ভোগন্তির অন্যতম কারণ, ইন্সটাইলেশন প্রক্রিয়া জটিল ছিলো। লগইনে অনেক সময় নষ্ট হয়। এছাড়া ডিভাইস নির্ধারণের প্রয়োজন হয়। অনেক লোক ভিডিও কনভার্সনে যোগ দিলে ওয়েবেক্সের সিস্টেম চাপ নিতে সক্ষম হয় না, যার ফলে অডিও এবং ভিডিওর রেজুলেশন হ্রাস পায়।
এরিক তার উর্ধ্বতনদের ওয়েবেক্সের ত্রুটিগুলো ও আপগ্রেডের প্রয়োজন বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষমেষ তিনি ভিডিও কনফারেন্সিং ব্যবসায় পরিবর্তন আনবেন বলে ঠিক করেন। ওয়েবেক্সের সাথে তার ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর সম্পর্ক শেষ করে বেড়িয়ে আসেন। এসময় আরও ৪০জন ইঞ্জিনিয়ার ওয়েবেক্স ছেড়ে চলে আসেন এবং এরিকের সাথে যোগ দেন।
এরিকের সামনে প্রধান বাঁধা ছিলো বাজারে তখন ওয়েবেক্স, স্কাইপ, গুগল হ্যাংআউট পুরোদমে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই বিনিয়োগকারীরা এরিকের নতুন উদ্যোগে অর্থলগ্নি করতে কেউই উৎসাহিত হননি। এসময় এরিকের পাশে এগিয়ে আসেন ওয়েবেক্সের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন সিইও সুব্রাহ আইয়ার। তিনি ৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন।
২০১১ সালের ২১ এপ্রিল এরিক ইয়ানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। ২০১২ সালের মে মাসে কোম্পানির নামকরণ করা হয় জুম (ZOOM)। আমেরিকান শিশুসাহিত্যিক থ্যাচার হার্ডের বই জুমসিটি (ZOOM CITY) দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সংস্থাটির নাম পরিবর্তন করা হয়। ২০১২ এর সেপ্টেম্বরে, অ্যাপটির একটি বেটা সংস্করণ চালু করা হয়। যেখানে হোস্টের সাথে ১৫ জন স্ক্রিন শেয়ার করতে পারে।
বেটা সংস্করণটি ব্যবহারকারীদর দ্বার প্রশংসিত হয়। সেবছর নভেম্বরে সংস্থাটি তার প্রথম গ্রাহক হিসাবে বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে স্বাক্ষর করে। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে তারা, তাদের প্রথম পণ্য বাজারে আনা হয়। যা দ্রুতই ৬ মিলিয়ন ডলার সিরিজ অ্যা রাউন্ড সম্পন্ন করে। ২০১৩ এর মে মাসের মধ্যে, অ্যাপটিতে ৪ মিলিয়নের বেশি কনফারেন্স এবং ৩৫০০ বিজনেস সম্পন্ন করে। যা তাদের ১ মিলিয়ন গ্রাহকের কাছে পৌঁছতে সাহায্য করে।
জুম অ্যাপ ও জ্যাকপট কোভিড-১৯
কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে দুঃসময় বয়ে আনলেও জুমের জন্য হয়ে ওঠে গোল্ডেন টাইম। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জুমের রেভিনিউ ছিলো ৩৩০.৫ মিলিয়ন ডলার। যা একটি স্টার্টআপ কোম্পানির জন্য যথেষ্ট ছিলো। তবে কোভিড-১৯ জুমে একটা বুস্ট এনে দেয়। ২০২০ এর প্রথম তৃতীয়াংশে জুমের রেভিনিউ ১৬৯শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২৮.২ মিলিয়ন ডলার। চলতিবছর মে মাসে জুমের গ্রাহক সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৩০০ মিলিয়নের বেশি। প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড হয়েছে ১০০ মিলিয়নের বেশিবার। জুমের (ZOOM) স্টক প্রাইস বেড়েছে ৩০০শতাংশ। বর্তমান মার্কেট ভ্যালু ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
[আরও পড়ুন-
এবার বিলিয়নিয়ার হাওয়ার দ্বারপ্রান্তে মেসি
ইন্টারনেট আসক্তি ছুড়ে ফেলুন চার বৈজ্ঞানিক উপায়ে ]
জুম অ্যাপ কেনো সেরা
সবঠিক আছে কিন্তু প্রশ্ন হলো বাজারে সিস্কো ওয়েবেক্স, মাইক্রোসফটের স্কাইপি, গুগল হ্যাংআউটের মতো পরিসেবা থাকতে জুম (ZOOM) কেনো সেরা?
এইপ্রশ্নের উত্তরে বেশকিছু কারণ দাঁড় করানো যায়। তবে প্রথম কারণটার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবো ২০১১ সালে। এরিক ইয়ান ওয়েবেক্স ছেড়েছিলেন গ্রাহকদের সেবার মান বাড়ানো নিয়ে সিস্কো ওয়েবেক্স কর্তাব্যক্তিদের আগ্রহ না পেয়ে। এরিক ফোর্বসকে জানান, ওয়েবেক্স তার কাছে সন্তান। তাই গ্রাহকদের এটিতে সন্তুষ্ট না হওয়া তার পছন্দ হয়নি। একারণে নির্মাতা টিম গ্রাহকদের সন্তুষ্টি নিয়ে প্রথমে কাজ শুরু করে। যা তাদের কাজ শেষে ফলাফলও পাইয়ে দেয়।
• তবে এটাকে মূলকারণ বললে বোকামির পরিচয় দেওয়া হবে। অনেকের মতে এটির ৪০ মিনিটে ১০০ জনের ফ্রি কনফারেন্স জনপ্রিয়তার মূল কারণ।
• অ্যাপটি বাজারে আনার সময় গ্রাহক সন্তুষ্টি মাথায় রেখে এটিকে সহজতর করে তোলা হয়। অ্যাপটির প্রধান বৈশিষ্ট্য এটি ইউজার ফ্রেন্ডলি। ক্রোম, সাফারি, ফাইরবক্সসহ সকল ব্রাউজেরই এটি ব্যবহার করা যায়।
• অ্যাপ ডাউনলোড, একাউন্ট খোলা, লগইনের ঝামেলা পোহাতে হয় না, হোস্টের দেওয়া লিংকে ক্লিক করলেই কনফারেন্সে ঢোকা যায়, যা সময় সাশ্রয় করে।
• এছাড়াও প্রিমিয়াম প্যাকেজে ১৪.৯৯-১৯.৯৯ ডলারে ১০০০ জনও কনফারেন্সে অংশ নিতে পারে। যেখানো অন্য পরিসেবাগুলোআরও বেশি ডলার বেশি নিয়ে থাকে। যেখানে ওয়েবেক্সে ২৬.৯৫ ডলার ২০০ জন কনফারেন্সিং করা যায়, সেখানে ১৯.৯৯ ডলারে ৩০০ জন সুযোগ পায়। সবমিলিয়ে এটা সাশ্রয়ী।
• অ্যাপটিতে ডেটা উইজ কম করে। ফলে দূর্বল নেটওয়ার্কেও সমস্যা হয় না।
• বাকিরা যেখানে অডিওকে প্রাধন্য দিয়েছে সেখানে জুম (ZOOM) সবারআগে ভিডিও নিয়ে কাজ করেছে। ফলে তাদের ভিডিওর মান অন্যদের থেকে সেরা।
নিরাপত্তা বিতর্ক
অ্যাপটির কোনো পাসওয়ার্ড না থাকায় যে খুশি কনফারেন্সে ঢুকে যেতে পারে এবং যা খুশি সম্প্রচার করতে পারে। এছাড়াও এর আইওএস থেকে তথ্য পাচারের অভিযোগ করেছেন অনেক ব্যবহারকারী। কোম্পানির ডিরেক্টরি সেটিংসেও সমস্যা রয়েছে যা ব্যবহারকারীর মেইল এবং ফটো ফাঁস করতে পারে। ফলে জুন থেকে সংস্থাটি ৯০ দিনের জন্য তাদের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ করে নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো সমাধানের ঘোষণা দেয়।
বিতর্ক কিংবা জনপ্রিয়তা যায় থাকুক জুম অ্যাপ বর্তমান জায়ান্টদের তালিকায় নিজের নাম তুলেছে এটা মানতেই হবে। মহামারীর সময়ে সহজ করেছে গোটা বিশ্বের কাজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো করোনা পরবর্তী সময়ে কি থাকবে জুমের এই উত্থান?
[ হিট গেম টেম্পল রান, বিশ্বজুড়ে গেম বাজারে যার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। টেম্পলরানের সাফল্যের রহস্য জানতে পড়ুন, টেম্পল রান যেভাবে পেলো অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা ও সাফল্য ]